কিডনি ও মূত্রনালির রোগজীবাণুজনিত সংক্রমণকে ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন (ইউটিআই) বলে। কিডনি ও পেলভিসের ইনফেকশনকে ওপরের মূত্রনালির ইনফেকশন বা একিউট পাইলোনেফ্রাইটিস বলে।
কিডনিতে স্থায়ীভাবে দাগ পড়ে গেলে তখন ক্রনিক পাইলোনেফ্রাইটিস হয়। নিম্নের মূত্রনালির ইনফেকশনকে সিস্টাইটিস বলে। এ ধরনের মূত্রনালির ইনফেকশন প্রতিরোধ করা সম্ভব।আমাদের দেশে এ সমস্যায় বেশি ভোগেন সাধারণত নারীরা।যেসব নারীরা কর্মজীবী তাদের জন্য বেশিরভাগ জায়গাতেই নেই পর্যাপ্ত টয়লেটের সুবিধা।অন্যদিকে যারা বাসায় থাকেন তারা ঘরকন্যার কাজে এতটাই মগ্ন থাকেন যে অনেকে সময় প্রস্রাব আটকে রাখেন।আবার দেখা যায় অনেক নারীই আছেন যারা জানেনই না পার্সোনাল হাইজিন মেইনটেইনের বিষয়টি। এসবের ফলাফলস্বরুপ দেখা দেয় ইউরিন ইনফেকশন।
কাদের বেশি হয়ঃ
পুরুষের তুলনায় নারীদের ইউটিআই হয় চার গুণ বেশি। সাধারণত ১৫ থেকে ৬০ বছরের নারীরাই এতে বেশি ভোগে, যার প্রকোপ ২০ ভাগ। গড়ে প্রায় ৫০ ভাগ নারী বিশেষ করে যৌন সক্রিয় বয়সে ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশনের (ইউটিআই) উপসর্গে ভুগতে থাকে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সঠিক জ্ঞানের অভাবে বেড়ে যায় ইউরিন ইনফেকশনের মাত্রা।
ইউটিআইয়েএ লক্ষণসমূহঃ
১.হঠাৎ উচ্চমাত্রার জ্বর বা জ্বর জ্বর লাগা, কোমরের দুই পাশে ব্যথা, তলপেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব, প্রস্রাবে প্রচণ্ড জ্বালাপোড়া, চুলকানো।
২. দুর্গন্ধময় প্রস্রাব। অনেক সময় ফেনাযুক্ত প্রস্রাব হয়। সঠিকভাবে না-ও হতে পারে।
৩. অনেক সময় মূত্রের সঙ্গে রক্তও যেতে পারে।
৪. ঊরুর দুই কোনাতে ব্যথা থাকতে পারে।
৫.শিশুদের ক্ষেত্রে বিছানায় প্রস্রাব করা ও ঠিক মতো বেড়ে না উঠার প্রবণতা দেখা দেয়।
৬.পেটের পীড়া যেমন ডায়রিয়া, অজীর্ণ দেখা দিতে পারে।
ইউরিন ইনফেকশনের ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা গুলো হলোঃ
১. জননতন্ত্রের ইনফেকশন।
২. দীর্ঘ সময় যাবৎ মূত্র ত্যাগ না করা বা আটকে রাখা।
৩. একবার ইউরিনে ইনফেকশন হলে আবারও হওয়ার আশঙ্কা থাকে, যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হয়।
৪. যাঁরা পানি খুব কম খান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে পারেন না, দিনের পর দিন এ সমস্যা চলতেই থাকলে, তাঁদের ইউরিনে ইনফেকশন হয়।
ইউরিনের ইনফেকশনের জন্য দায়ী প্রধান ব্যাকটেরিয়া হলো ই কোলাই। এই ব্যাকটেরিয়া পাকস্থলী ও খাদ্যনালিতে থাকে। রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা কমে গেলে এই ব্যাকটেরিয়া জননতন্ত্রে বাসা বাঁধতে পারে। একজন নারী বা পুরুষ সঠিক সময়ে মূত্র ত্যাগ না করে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখে, তখন ই কোলাই দ্রুত আক্রমণ করে।৫. বড় কোনো অস্ত্রোপচারের পরে ক্যাথেটার (মূত্র নির্গমনের জন্য দেওয়া বিশেষ ধরনের নল) দেওয়া থাকে। ক্যাথেটার দীর্ঘদিন থাকলে এবং সঠিকভাবে পরিষ্কার না করলেও ইউরিনে ইনফেকশন হয়। যাঁদেরকে ডায়াপার পরে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়, তাঁদেরও এ সমস্যা হতে পারে।
৬. একাধিক নারী-পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক, স্যাঁতসেঁতে জায়গায় বসবাস, অতিরিক্ত নোংরা টয়লেট ব্যবহার করা, নিয়মিত গোসল না করা, যৌন রোগে আক্রান্ত বা রোগীদের ইউরিনে ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি।
৭. কিডনি বা জননতন্ত্রের কোথাও পাথর থাকলেও এ সমস্যা হয়।
প্রতিকার
১.নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি, পুষ্টিকর খাবার, মৌসুমি ফল খেতে হবে।
২. ঘুমানোর আগে মূত্র ত্যাগ করে ঘুমাতে হবে।
৩. নিয়মিত গোসল ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। পরিধেয় বস্ত্র, বাসস্থান, টয়লেট পরিচ্ছন্ন হওয়াটা জরুরি।
৪. যাদের কিছুদিন পর পর ইউরিনে ইনফেকশন হয়, তাঁরা দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৫. ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
৬. যাঁরা অতিরিক্ত ঘেমে যান, তাঁরা নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করতে হবে।
৭. সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে জনগণের কল্যাণে টয়লেট স্থাপন করতে হবে।
কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বনঃ
ইউরিন ইনফেকশন এমনই এক সমস্যা যা একবার হলে বারবার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ঘন ঘন ওষুধ না খেয়ে বরং ঘরোয়া কিছু প্রতিকারের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। যেমন-
১. ইউরিন ইনফেকশন হলে অনেক চিকিৎসকই রোগীদের পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন সি খাওয়ার পরামর্শ দেন। এটি মুত্রথলি ভাল রাখে এবং প্রস্রাবের সময় জ্বালা ভাব কমাতে সহায্য করে। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতেও সহায়তা করে ভিটামিন সি। তাই ইউরিন ইনফেকশন হলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খাওয়া উচিত।
২. প্রতিদিন অন্তত তিন লিটার পানি পান করা উচিত। বিশেষ করে প্রস্রাবে হলুদ ভাব দেখা গেলেই দেরি না করে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা উচিত।
৩. আনারসে ব্রোমেলাইন নামক উপকারী এনজাইম থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, ইউরিন ইনফেকশনে আক্রান্ত রোগীদের সাধারণত ব্রোমেলাইন সমৃদ্ধ অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। তাই ইউরিন ইনফেকশন হলে প্রতিদিন এক কাপ আনারসের রস খান।
৪. ইউরিন ইনফেকশন হলে দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে সংক্রমণ কিডনিতে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থেকেই যায়। তাই যত দ্রুত সম্ভব এটি নিরাময় করা উচিত। আধা চামচ বেকিং সোডা এক গ্লাস পানিতে ভাল করে মিশিয়ে দিনে একবার করে খেলে প্রস্রাবের সময় জ্বালা বা ব্যথা ভাব অনেকটাই কমে যাবে।
ইউটিআইয়ের চিকিৎসাঃ
কারও যদি মনে হয় তার শরীরে উপরোক্ত লক্ষণগুলো বিদ্যমান তবে কালবিলম্ব না করে urologist, gynaecologist বা nephrologist এর শরণাপন্ন হতে হবে। বয়স, রোগের তীব্রতা ও রোগের জন্যে দায়ী জীবাণু অনুযায়ী একেক জনকে একেক পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। তবে প্রচুর পরিমাণে পানি খেলে এই রোগ হওয়ার চান্স কমে যাবে এবং হলেও তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাবে। অতিরিক্ত পানি খাওয়ার দরকার নেই। প্রসাবের সাধারণ রং খড়ের ন্যায় , সাদা নয় । যত টুকু পানি খেলে প্রস্রাব খড়ের মত হবে, ততটুকুই যথেষ্ট । তবে সাধারণত ২- ২.৫ লিটার পানি পান করা ভালো। মনে রাখতে হবে, অনেক সময় প্রস্রাব আটকে রাখলে ব্যাকটেরিয়াকে একটি আবাসস্থল তৈরির সুযোগ করে দেয়া হয়, যা শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। নিয়ম মেনে চলে সুস্থ থাকুন, আশেপাশের মানুষকেও সচেতন করুন।
লেখক
তাজলিনা শারমিন খান
নিউট্রিশনিস্ট ও ডায়েটিশিয়ান
কনসেল হেলথ, ক্লে বিউটি অ্যান্ড স্পা, জেনারেল মেম্বার অ্যাট বাফনা